কোথাও একটা ঘুরতে যেতেই হবে। বেশ কদিন বাড়িতে বসে আছি , আরো বসে থাকলে তো কুঁড়ে হয়ে যাবো। আমার বেড়ানোর একটা শর্টকাট আছে , যখন কোথাও যেতে পারি না তখন আমি গুগল ম্যাপে বেড়াই।

গুগল আমাকে দেখালো একটা জায়গায় গঙ্গার ধরে বেশ কয়েকটা জাহাজ পড়ে আছে। জাহাজ !!!! আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না , আমি গুগলে আমার হাতের নাগালের মধ্যে, একটা নয় দুটো নয় , এক গাদা জাহাজ আবিষ্কার করলাম ? প্রফেসর শঙ্কুর মতো ইউরেকা বলে চেঁচালে পাশের বাড়ির লোক গাল দিতে পারে, কিন্তু এতো বড়ো একটা আবিষ্কার !!! আমি মনে মনে কলম্বাস হয়ে উঠলাম , পাল তোলা জাহাজ ? না তা আজকের দিনে হবেনা নিশ্চই। জাহাজের কথা মনে হলেই আমার আবার ওই ইংরিজি মুভির কথা মনে পড়ে — “Pirates of the Caribbean” আরো কত ছোটবেলায় পড়া জলদস্যুদের গল্প। সব জলদস্যুই কি কানা ছিল ? এটা আগে ভেবে দেখিনি। আমার মনে পড়লো আমি অনেক বছর আগে ফ্যান্সি মার্কেট থেকে অনেক দাম দস্তুর করে একটা কালো সানগ্লাস কিনেছিলাম কড়কড়ে ১৩৫ টাকা দিয়ে যার একটা কাঁচ খুলে পড়ে গিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই। ইস ওটা যদি এখন খুঁজে পেতাম , একবার ওটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক চোখো জলদস্যু হলে কেমন হতো দেখতে পারতাম।
বেশি ভেবে কাজ নেই , আমার ছোট্ট স্ক্যুটিটা নিয়ে সোজা পেট্রোল
পাম্প গিয়ে ১৫০ টাকার তেল ভর্তি করতেই ফুল ট্যাঙ্ক । জায়গা টা সাঁকরাইল রেল স্টেশনের পেছন দিকে। এই স্টেশন অব্দি রাস্তা আমি চিনি। এবার আমার হাওয়ার সঙ্গে রেস লাগানোর পালা, হাইরোডে প্রানপনে স্ক্যুটির এক্সেলারেটরটা ফুল করে চেপে ধরলাম ,কি তার দুর্নিবার গতি, সামনে সোজা রাস্তা মাথার ওপর কালো মেঘ , ঝোড়ো হাওয়ার মতো দমকা হাওয়া গায়ে ঘষা খাচ্ছে , মাথায় নরকের বন্ধুকে পরে আছি , আছাড় খেলেও যাতে মাথাটা বাঁচে। এতকিছু করে স্পীড মিটারে দেখি মাত্র ৮০ , এরথেকে বেশি আর হয়না আমার স্ক্যুটিতে। দেখতে দেখতে ধুলাগড়ি ট্রাক টার্মিনাস কে ডান দিকে রেখে ওর পাস দিয়ে যে রাস্তাটা সোজা চলেগেছে সাঁকরাইল স্টেশন, সেটা ধরে নিলাম।

এ রাস্তাটা বেশ শান্ত , কোনো বড়ো লরি চলে না, বাস বা গাড়ির হর্ণের অত্যাচার নেই , রাস্তার দুপাশে চকচকে সবুজ ধানখেত। কলকাতা থেকে, মানে রবীন্দ্র সদন থেকে মাত্র ২০ কিমি দূরে এরকম একটা জায়গা থাকতে পারে , আমার ধারণা ছিলোনা। রেল স্টেশন পেরিয়ে তার পেছন দিক দিয়ে এঁকেবেঁকে এক গাদা দোকান আর বাড়ির মধ্যে দিয়ে চললাম আমার উদ্দেশ্যের দিকে। একটা মোড়ে সামান্য একটু রাস্তা ভুল করা ছাড়া আর কোনো বিপত্তি ঘটেনি। গুগল দাদা ঠিক রাস্তা দেখিয়ে আমায় নিয়ে এসে হাজির গঙ্গার পাড়ে। মনে মনে জিজ্ঞাসা করি , জাহাজ কই ?


একটা বেশ উঁচু পাঁচিল ঘেরা জায়গা আর একটা বড়ো নীল রঙের লোহার গেটে একটা জাহাজ সারানোর কোম্পানির নাম লেখা আছে। স্যার আইজাক নিউটন বর্ষার সময় ওনার পোষা বেড়াল যাতে দরজা বন্ধ থাকলেও তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকতে পারে তাই দরজায় একটা গর্ত করেছিলেন।বড়ো লোহার গেটে সেরকমই একটা ছোট দরজা ছিল যেটা ঠেলে নিচু হয়ে ভেতরে ঢোকা যেতে পারে। ঢোকার পরমুহূর্তে পড়লাম গেট দাদার খপ্পরে, “কি ব্যাপার ? কোথা থেকে এসেছেন ? ভেতরে ঢুকলেন কেন ? পারমিশন আছে ? ” বাবাঃ, লোকটার মুখে মেশিনগান লাগানো নাকি ? কয়েক মুহূর্ত চুপ করে গেটদাদার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে, তারপর বললাম — ” দাদা পাগল দেখেছেন ? না দেখে থাকলে দেখেনিন সামনে দাঁড়িয়ে আছি , এসেছি কলকাতা থেকে , ম্যাপে জাহাজ দেখে মাথাটা আরো খারাপ হয়েছিল। ” এবার দাদা হেসে ফেললো। প্রাচীন কালে কোনো এক হিন্দি মুভিতে শুনেছিলাম “হাসি তো ফাসি “।ফল স্বরূপ একটু ঘোরাঘুরি করার অনুমতি পেলাম ,কিন্তু কোনো মতেই জাহাজের খুব কাছে যাওয়া যাবে না , বা জাহাজে ওঠার তো কোনো ব্যাপারই নেই। এবার চারপাশ দেখে আমি তো অবাক , বেশ কয়েকটা জাহাজ এখানে ওখানে মাঠের ওপর পড়ে। জাহাজগুলো বিশাল বড়ো না হলেও মোটামুটি খারাপ না। চোখের সামনে শুকনো মাটিতে একগাদা জাহাজ এদিকে ওদিকে বসে আছে, এই কি কম কথা !

সেলফোনে ছবি তোলার সময় চোখে পড়লো বাঁ দিকে গঙ্গার পাড়ের কাছে একটা ইটভাটার চিমনি আর তার ঠিক পেছনে একটা বড়োসড়ো জাহাজের মুখ দেখা যাচ্ছে , যেখানে টাইটানিকের নায়িকা আর নায়ক দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে প্রেম করছিলো। মনে মনে জাহাজটার নাম দিলাম টাইটানিক। ঘুরে পথে ওটার কাছে যেতে হবে।


গেটদাদাকে বিদায় জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে, চললাম ওই ইটভাটার দিকে। ইটভাটায় ঢুকে তো আমি অবাক , এ তো নালন্দা !!! ছোট বেলায় বাবা মায়ের সঙ্গে বাস এ করে রাজগীর ট্যুরে নালন্দা দেখেছিলাম, চার দিকে ইটের দেওয়াল। ইটের স্তুপের মধ্যে দিয়ে লাল মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এক ভদ্রলোকের মুখোমুখি হতে বুঝলাম , ইনি এখানকার রক্ষনাবেক্ষন করেন। মিথ্যা বলবো ? নাঃ দেখি সত্য বা মিথ্যা কোনোটাই না বলে যদি কিছু করা যায়। উনি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম “দাদা এখানে আগে কোনো বাংলা সিনেমার শুটিং হয় নি তো ? ” উনি বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন “কই, না তো ” . আমি বললাম ” হুম , তাহলে জায়গাটা ঘুরে দেখতে হয় , কি বলেন ?” উনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। যাক আমার উদ্দেশ্য সাধনে আর কোনো বাধা নেই।


নদীর ধরে এলাম। আমার ১০ হাত দূরে একটা প্রায় ২০০ ফুট লম্বা জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। টাইটানিকের মতো নয় কিন্তু জাহাজ তো বটে , মনের সুখে জাহাজ দেখে দুএকটা ছবি ও তুললাম। কয়েকটা লোক জাহাজটার ওপর বসে ওয়েল্ডিং করছে কেউ বা রং করছে।

জাহাজটিতে ওঠার জন্য একটা বাঁশের মই ও লাগানো আছে। মনে মনে ভাবলাম ওঠা ঠিক হবে না, গেটদাদা বারণ করেছিলেন। জাহাজ ছেড়ে গঙ্গার পাড়ে একটা ইট বিছানো শ্যাওলা ধরা জায়গায় বসে বরং গঙ্গা দেখি। এখানে গঙ্গার পাড় কুঁচো বা অব্যবহার্য ইট এ ভর্তি তাই কাদা নেই , হালকা পচা কচুরিপানার গন্ধ ছাড়া কোনো অসুবিধা নেই। সামনে একটু দূরে কটা ডিঙি নৌকা বেশ লাগে দেখতে।
গঙ্গা টা এতটাই চওড়া যে আরেকটু হলে কাদা জলের সমুদ্র বলে ভুল হতো। গঙ্গার অপর পাড়টা বেশ অদ্ভুত , গাদা গাদা ইটভাটার চিমনি যেন কাঁটাগাছের ডালে লেগেথাকা কাঁটার মতো উঠে আছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে ,
এবার তো পকেট থেকে ছোট্ট পানীয় বের করতেই হয়। এরকম মনোরম নির্জন জায়গায় একটু অন্য রকম কিছু ভাবার জন্য কিছু তো চাই 🙂
গঙ্গা টা এতটাই চওড়া যে আরেকটু হলে কাদা জলের সমুদ্র বলে ভুল হতো। গঙ্গার অপর পাড়টা বেশ অদ্ভুত , গাদা গাদা ইটভাটার চিমনি যেন কাঁটাগাছের ডালে লেগেথাকা কাঁটার মতো উঠে আছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে ,
এবার তো পকেট থেকে ছোট্ট পানীয় বের করতেই হয়। এরকম মনোরম নির্জন জায়গায় একটু অন্য রকম কিছু ভাবার জন্য কিছু তো চাই 🙂
আমার মাথার ওপর বেশ বড়ো একটা গাছ জায়গাটাকে বেশ রহস্যময় সুন্দর করে তুলেছে , গঙ্গার জল ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ করে হেসেই যাচ্ছে , ডিঙি নৌকাগুলোতে একটা করে টিমটিমে হলুদ আলো, দেখতে দেখতে গঙ্গা চকচকে কালো হয়ে যাচ্ছে আর ওপাড়ে ধোঁয়াশার মধ্যে টুক টুক করে একটা করে আবঝা আলো জ্বলে উঠছে। বেশ কিছুক্ষন বসার পর আমার বেশ পিছুটান অনুভব হলো , পিছুটান মানে বাড়ি ফেরার টান নয় , ওই ইটের টুকরোর ওপর বেশিক্ষন বসে থাকলে যা হয়। নাঃ , ওঠা যাক বেশ অন্ধকার হয়েছে।
